* বাসে অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির দৌরাত্ম্য বেড়েছে * ছিনতাইকারী ও ডাকাত আতঙ্কে নগরবাসী * মহাসড়কে আতঙ্কে থাকেন যাসের যাত্রীরা
রাজধানীতে প্রতারণার নতুন ফাঁদ শয়তানের নিঃশ্বাস
তুরাগ থেকে মনির হোসেন জীবন
রাজধানীতে এক শ্রেণির প্রতারকরা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ নামে পরিচিত মাদক ‘স্কোপোলামিন’ ব্যবহার করে নিত্যনতুন কিংবা অভিনব কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে নগদ টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার। এছাড়া রাত গভীর হলেই নগরীর সড়ক কিংবা মহাসড়কে বাড়ে ডাকাত-ছিনতাইকারী আতঙ্ক। প্রায়ই রাতে মহাসড়কে কিংবা বাড়িঘরে ডাকাতি কিংবা দস্যুতার মতো ঘটনা ঘটছে। নগরজুড়ে এক শ্রেণির দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন কৌশলে যাত্রীবাহী বাস ও প্রাইভেটকার থামিয়ে অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে লুটে নিচ্ছে নগদ অর্থ ও দামি সব মালামাল। শুধু রাতেই নয়, দিনদুপুরেও সড়কে যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে, গাছ ফেলে হানা দিচ্ছে ডাকাতরা। বিদেশগামী যাত্রী কিংবা প্রবাস ফেরত মানুষগুলো ছিনতাইকারী, ডাকাত আর অপহরণকারী টার্গেটের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া যাত্রীবাহী বাসে অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে।
ভুক্তভোগী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে প্রতিনিয়তই চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, অপহরণ, শিশু-নারী নির্যাতন, শয়তানের নিঃশ্বাসসহ নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ড একের পর এক বেড়েই চলেছে। ঢাকার সড়ক মহাসড়ক দিন কিংবা রাতের অন্ধকারে যে সব স্পটে ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয় তার মধ্যে উল্লখযোগ্য হলো-ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা বিমানবন্দর সড়ক, মহাখালী গুলশান সড়ক, উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে মহাখালী, সাতরাস্তা, বিশ্বরোড-যাত্রাবাড়ী সড়ক, আমিনবাজার -গাবতলী সড়ক, মিরপুর ১০ নং, ফার্মগেট সড়ক, উত্তরার আব্দুল্লাহপুর-মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়ক, নগরীর উড়ালসড়ক, (উড়ালসেতু) প্রমুখ। এছাড়া-সিরাজগঞ্জে যমুনা সেতুর পশ্চিম সংযোগ মহাসড়ক, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর,পাবনার সাঁথিয়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা গোপালগঞ্জ, মাওয়া এক্সপ্রেস রুট, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, মদনপুর, কাঁচপুর, সোনারগাঁও ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঘোড়াশাল, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ঢাকা ফেনী, কক্সবাজার রুটসহ উত্তর বঙ্গের ৩২টি রুটও দক্ষিণাঞ্চলের সড়কও মহাসড়কগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুযোগ পেলে কৌশলে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও নাইটকোচে থাকা যাত্রীদের মোবাইল ও নগদ অর্থ লুট করে নিয়ে যায়। এ অবস্থায় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চলাচলকারী বাসে যাত্রী কমছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও ঢিলেঢালা টহলের কারণেই ডাকাতি-ছিনতাই বাড়ছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। আতঙ্কে সড়ক-মহাসড়কে ক্রমেই রাতে দূরপাল্লার যাত্রী কমছে বলে দাবি করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের গত জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মুন্সীগঞ্জের ভবেরচর, কুমিল্লার দাউদকান্দি এবং চৌদ্দগ্রাম এলাকায় অন্তত ১২ থেকে ১৪টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গত ৯ মার্চ রাতে সিরাজগঞ্জে যমুনা সেতুর পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কের কোনাবাড়ীতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী একটি মাইক্রোবাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে পাবনা-সাঁথিয়া আঞ্চলিক সড়কের ছেচানিয়া ব্রিজের পাশে বাস-ট্রাকে গণডাকাতির ঘটনা ঘটে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফালগুনকরা এলাকায় প্রবাসী চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জের নাইমুল ইসলামের সর্বস্ব কেড়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। একই এলাকায় গত ১ মার্চ শনিবার ভোরে ডাকাতের কবলে পড়েন দাগনভূঞা থানার মালয়েশিয়া প্রবাসী মো. বেলাল আহমেদ। এছাড়া গেল দুই মাসে মহাসড়কে চৌদ্দগ্রাম অংশে আরও চারটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ভোর সোয়া ৪টার দিকে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে একাধিক বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সূত্রগুলো বলছে, গত দেড় মাসে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছে। তবে সড়কে ডাকাতির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। অনেকেই ঝামেলা এড়াতে মামলা করছেন না। এ মহাসড়কে চলাচলকারী চালকরা জানিয়েছেন, ডাকাতদের প্রধান টার্গেট ‘প্রবাসীরা’। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া পরিচয়, ভুয়া পোশাক, নকল খেলনা পিস্তল দেখিয়ে ছিনতাই- ডাকাতি করা হচ্ছে মহাসড়ক সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায়। এ ছাড়া বিভিন্ন টোলপ্লাজার হকাররা এবং হাইওয়ের বিভিন্ন হোটেল থেকে তথ্য দিয়েও ডাকাতদের সহযোগিতা করা হয়। ফলে রাতে যাত্রী ও যানবাহনের চালকদের কাছে আতঙ্কের জনপদ এখন মহাসড়ক। এদিকে হাইওয়ে পুলিশ বলছে, দেশের সব মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাই প্রতিরোধে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া শুরু হয়েছে। জেলা পুলিশের সমন্বয়ে হাইওয়ে পুলিশ এই নিরাপত্তা দিচ্ছে। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত ফোর্স হাইওয়েতে দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় জড়িত। কেউ গার্মেন্টসে খণ্ডকালীন কাজ করেন। আবার কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন বা অটোরিকশা চালান। এরাই রাতের বেলা হয়ে ওঠেন ভয়ংকর। ফোন করে হুমকি দেন। নিয়মিত মাসোহারা না পেলে গাড়ি থামিয়ে নগদ টাকা, দামি মালামাল ও মোবাইল লুট করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক রুটের এক পরিবহন ব্যবসায়ী বলেছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, মদনপুর, কাঁচপুর, সোনারগাঁও ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঘোড়াশাল টোলপ্লাজা থেকে ইটাখোলা মোড় পর্যন্ত পয়েন্টে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। এদের নিয়মিত মাসোহারা দিতে হয়। থানা ও হাইওয়ে পুলিশ বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-মানিকগঞ্জ, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-পাবনাসহ দেশের সব মহাসড়কে নিরাপত্তা জোরদার করতে ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরের উচ্চপর্যায়ে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাতে ডাকাত আতঙ্কে কমেছে যাত্রীসংখ্যা। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাস মালিকরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাস বন্ধ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়কে ডাকাতি-ছিনতাই ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করছে। যার কারণে ক্রমেই যাত্রীসংখ্যাও কমে আসছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। সড়কেও এখনো পুলিশ সক্রিয় হতে পারেনি।
এদিকে হাইওয়ে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, সম্প্রতি মহাসড়কে বেশ কিছু ঘটনার পর চেষ্টা করা হচ্ছে ডাকাতির ঘটনা কমিয়ে আনার। ডাকাত ধরতে একটি ডাটাবেইস তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে অনেক ডাকাত ও সন্ত্রাসী এবং অপরাধী কারাগার থেকে জামিন পেয়েছে। তাই আমরা ১ হাজার ৪৪০ জনের একটি তালিকা করেছি, তাদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা ও থানাকে অভিযুক্তদের নাম-পরিচয় জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। যাতে তাদের বিরুদ্ধে সমন্বিত অভিযান চালানো যায়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মহাসড়কে যেসব জায়গায় ডাকাতি হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেসব জায়গায় নিরাপত্তা জোরদার করছে। তিনি বলেন, সড়ক মহাসড়ক গুলোতে ডাকাতিও ছিনতাই রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। হাইওয়েতে ডাকাতির রেড জোন চিহ্নিত করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা থেকে রাজশাহী জোন ও উত্তরবঙ্গের দূরপাল্লার মহাসড়কে তুলনামূলকভাবে ডাকাতির সংখ্যাটা একটু বেশি। মাঝেমধ্যে টাঙ্গাইল-যমুনা সড়কেও বেশি হয়ে থাকে। তবে ডাকাতি যেন না হয়, সে জন্য ওই এলাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ইন্সট্রাকশন দিয়েছি। তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর হচ্ছে। দেশের হাইওয়েগুলোতে থানা ও হাইওয়ে পুলিশের একাধিক টীম মাঠে কাজ করছে।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ